Blog

26 Apr 2020

Author: Dr. Md. Taibur Rahman

নভেল কভিড-১৯ সৃষ্ট বিপর্যয় এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জার্মানির আপাত সাফল্যের বিষয়ে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়

যেহেতু এখনও জার্মানিতেই আছি এবং প্রতিনিয়ত এখানকার খবর নেওয়ার সাথে সাথে আশেপাশের অবস্থাও পর্যবেক্ষন করছি তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে জার্মানির গৃহীত পদক্ষেপ নিয়েই এই লেখা।

করোনাভাইরাস সংক্রান্ত মৃত্যু এবং পরিস্থিতি

দেশটির করোনাভাইরাস সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ -এ দাঁড়িয়েছে এবং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যাল জানিয়েছে যে, কোভিড -১৯ দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলির মধ্যে এটি রেকর্ড সর্বনিম্ন মৃত্যুর হারের মধ্যেয়েছে। বিশ্বের সব দেশ বিশেষভাবে ইউরোপীয়ান দেশগুলি যখন করোনার প্রকোপ কমাতে হিমশিম খাচ্ছে, জার্মানিতে তখন কিছুটা সাফল্য দেখা যাচ্ছে। অদ্যাবধি, জার্মানিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেড়লাখের উপর হলেও এক লাখে দশহাজারের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে, যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ এবং এর বিপরীতে, মাত্র ছয়হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা গেছে, যা সুস্থতার তুলনায় যে কোনো দেশ থেকে কম। একটিভ কেসের সংখ্যাও কমে আসছে এবং প্রতিদিনের বৃদ্ধির হারও কমছে উলেখযোগ্য হারে।

 

ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিলকরণ এবং সতর্কতা

জার্মান ফেডারেল এবং রাজ্য সরকার সম্প্রতি কোভিড -১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োগ করা কিছু সামাজিক দূরত্বের নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিলরেছে, এর মধ্যে ৮০০ বর্গ মিটারের ছোট দোকানগুলি আবারও চালু করার অনুমতি দেসারা জার্মানি জুড়ে এখন সরকার আস্তে আস্তে আরও বড় মার্কেট বা অফিসগুলো খুলে দিচ্ছে। তবে মার্কেল সতর্ক করে বলেছেন, "এই অন্তর্বর্তীকালীন অর্জন খুবই ভঙ্গুর যেন আমরা পাতলা বরফের উপর আছিগত ২৩ এপ্রিল থেকে কিছুটা বিধিনিষেধ হ্রাস করার পরে, এই সপ্তাহে অনেক লোক শপিংয়ের স্থানগুলোতে জড় হতে শুরু করেছে। এর প্রেক্ষাপটে শীর্ষস্থানী জার্মান ভাইরাোলজিস্টরা এরকম আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। মার্কেল এখন ঘোষণা করেছেন যে ২৭ তারিখ থেকে জার্মানির ১৬ টি রাজ্যতেই গণ পরিবহন এবং দোকানগুলিতে ফেস মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। তিনি আহ্বান জানিয়েছে, "আমরা কী অর্জন করেছি তা যেন নষ্ট না করি।"

তবে মার্কেল জার্মানির সংসদে বলেছেন, করোনা ভাইরাস সঙ্কটে দেশটি এখনও "শুরুর দিকে" এবং এই ভাইরাসের সাথে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে হবে। তিনি যোগ করেছেন, "কেউ এটি শুনতে পছন্দ করে না তবে এটি সত্য আমরা এই সঙ্কটের শীর্ষ পর্যা এখনও পার হইনি" । চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সতর্ক করে বলেছেন, লকডাউন নিষেধাজ্ঞাগুলি যে কোনওভাবে কমিয়ে আনার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে হবে এবং জার্মানি করোনা ভাইরাসটির প্রসারকে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে যে সাফল্য লাভ করেছে তা টেকসই নয় এবং তা আবারও বেড়ে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে জার্মানিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি কাগজেকলমে শূন্য দশমিক নয় মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে (লকডাউন শিথিল করার সময় যা ছিল শূন্য দশমিক সাত), অর্থাৎ, সংক্রমণের গড় হার প্রায় ১:১ এই সংখ্যা একের নীচে রাখাই মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন জার্মান গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা৷ এই হার যত কমবে, পরিস্থিতির ততই উন্নতি হবে৷ কিছু এলাকায় এখনো এই হার একের বেশি৷ বিশেষ করে যেখানে বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোনো আবাসনে বেশি হারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে বর্তমান স্বাস্থ্যবিধি মেনেও কোনো লাভ হচ্ছে না৷ এই অবস্থায় সরকার মনে করে, দিনে সংক্রমণের সংখ্যা কয়েকশয় নেমে না আসা পর্যন্ত আরো বিধিনিয়ম শিথিল করার কোনো অবকাশ নেই৷

অন্যদিকে করোনা ভাইরাস যদি দ্বিতীয়দফাতে আবার মহামারীর মতো বাড়ে তার জন্যেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারা জার্মানি জুড়ে সরকারি হাসপাতালগুলোকে এখনই ইমারজেন্সি বেড এবং ডাক্তার নার্স তৈরি রাখতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন থেকে এক সপ্তাহ পর থেকে সবকিছু আস্তে আস্তে শিথিল করার কারণে আবারো এমন রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে, তার জন্য যাতে এখন থেকেই তৈরি হয়। ইতোমধ্যে সারা জার্মানিতে এখনই ১৩ হাজার বেড আলাদা করে তৈরি রাখা হয়েছে।(তথ্য সূত্রঃ জার্মান সংবাদপত্র)তার সাথে বার্লিনের “Messe Berlin” কে এখনই ভবিষ্যতের জরুরি হাসপাতাল বানাবার জন্য কাজ করছে। জার্মানিতে নতুন সংক্রমনের সংখ্যা কমে গেলেও যেভাবে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করছে তা থেকে অন্য দেশ শিক্ষা নিতে পারে।

প্রস্তুতি নিয়ে করোনা নিয়েই ধীর্ঘদিন বাস করতে হবে মনোভাব

জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশ জানিয়েছে, পরবর্তী বছরে যে কোনও সময়ের মধ্যে একটি ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা পদ্ধতি বের করার সম্ভাবনা অতি উচ্চভিলাষী। সুতরাং, এ বিষয়ে আমাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত এবং অন্যান্য সামাজিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হবে। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে মানুষের উপর কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে তবে এটা নিশ্চিত, সাধারণ জনগণের জন্য একটি ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত যেকোনো ধরনের স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না এবং এই ভাইরাস নিয়েই বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে

লকডাউন আরও শিথিল করা বা তুলে দেওয়ার উপায়ঃ ডিজিটাল কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ?

আশেপাশে থাকা কোনো ব্যক্তি কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত কিনা, আক্রান্ত ব্যক্তি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন এবং কারা তার সংস্পর্শে এসেছিলেন তা কনট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপের মাধ্যমে জানা যায়। ইবোলা মহামারী ঠেকাতেও একই ধরণের অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছিলো। যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে সংকেত পাঠিয়ে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরকে সতর্ক করতে পারবেন। এতে সেই ব্যক্তি সতর্ক হয়ে করোনা টেস্ট করতে পারবে বা আইসোলেশনে থাকতে পারবে

জার্মানিসহ দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইসরাইল, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া ইতোমধ্যে এটা ব্যবহার করছে তবে জার্মানিতে ব্যাক্তিগত গোপনীতার সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ন বিধায় সরকার আরও অধিক উন্নততর এবং স্মার্টফোনে ব্লুটুথ ব্যবহার করে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য বিশেষ অ্যাপ তৈরির কাজ করছেঅ্যাপল ও গুগলও এই বিষয়ে কাজ করছে এবং তাদের অপারেটিং সিস্টেমে অ্যাপটি যুক্ত করতে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে লোকেশন তথ্যের প্রয়োজন পরবে না। ফলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না তবে অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে এই অ্যাপের ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। বিপুল সংখ্যক মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করলে তবেই করোনাকে ঠেকানো যাবেবাংলাদেশ কিন্তু এই বিষয়ে জার্মানির সহায়তা চাইতে পারে।

কিভাবে সম্ভব হলো এই সাফল্য অর্জন?

প্রতি একলাখ মানুষের জন্য প্রায় ত্রিশটি আইসিইউ বেড আছে এখানে, যা ইউরোপে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আইসিইউ বেড আছে ইতালির, যা প্রতি একলাখের জন্য মাত্র সাড়ে বারোটি। উন্নত স্বাস্থ্য সেবা, অধিকহারে স্বাস্থ্য বীমা কভারেজ এবং সুদক্ষ ডাক্তার থাকার পরেও, গত ১১ মার্চ, মের্কেল আশংকা প্রকাশ করেন যে,  জার্মানির ৬০-৭০ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে এবং সবাইকে সতর্ক এবং আতঙ্কিত হতে আহবান করেছেনবলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এর চেয়ে বড় সংকটে জার্মানী এবং বিশ্ব আর কখনোই পড়েনি। তিনি পেয়েছেন একঝাক নিবেদিত মন্ত্রীসভার সহকর্মী। প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ পরামর্শ করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে। ভ্যাকসিনের কাজও চলছে, হিউম্যান ট্রায়ালও শুরু হয়েছে জার্মানি ইতোমধ্যে, করোনাকালীন ‘সেকেন্ড মোস্ট সেইফেস্ট কান্টট্রি ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড’র পর্যায়ে অবস্থান ছে। অন্য দেশের মতো কঠোর লকডাউনে না গিয়ে, অর্থনীতির চাকা সচল রেখে, যেভাবে করোনা বিপর্যয় সামাল দিচ্ছেন তা সত্যিই একজন দুর্দান্ত নেতার পরিচায়ক

এই সাফল্যের নেতা এঞ্জেলা মার্কেলের বিষয়ে কিছু না বললেই নয়। ১৯৫৪ সালে হামবুর্গে জন্ম নেওয়া এঞ্জেলা মার্কেল ২০০৫ সাল থেকে অদ্যাধি জার্মানির চ্যান্সেলর, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সবথেকে দীর্ঘ সময়ের সরকার প্রধান। গত ১৫ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নারীর উপাধীতে ভূষিত। ভৌত রসায়নে পিএইচডি করা এবং ক্যারিয়ারের শুরুতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করা ডক্টর মার্কেলের বিজ্ঞান বিষয়ক অর্জিত জ্ঞ্যান, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা এবং দুরদর্শী নেতাসুলভ দক্ষতার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলায়।

Image may contain: 2 people, people sitting, table and indoorমার্কেল বিষয়ক ছবি ও তথ্য সূত্রঃ https://www.theatlantic.com/international/archive/2020/04/angela-merkel-germany-coronavirus-pandemic/610225/