World Town Planning Day

09 Nov 2024

বিআইপি আয়োজিত ‘সমগ্র দেশের পরিকল্পনা করি, বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উদ্বোধনী এবং বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ উদযাপনের অংশ হিসেবে পৃথিবীকে পরিকল্পিত ও মানুষের বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এবং নগর পরিকল্পনার চিন্তা-চেতনা ও গুরুত্বকে সারা বিশ্বে পরিচিতকরণের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় এবছরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ৮ ও ৯ নভেম্বর ২০২৪ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। এবারের বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সমগ্র দেশের পরিকল্পনা করি, বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ গড়ি’।

এরই ধারাবাহিকতায়, রাজধানীস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স হলরুমে বিআইপির সুবর্ণজয়ন্তী এবং বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উদ্যোগে ৯ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে সকাল ১০:৩০ টা থেকে ‘সমগ্র দেশের পরিকল্পনা করি, বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বিআইপি’র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । এছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অবঃ), এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড এর ইমেরিটাস অধ্যাপক এ টি এম নুরুল আমিন এবং ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার জনাব শরফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । বিআইপি’র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান এর সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির এর সহ-সভাপতি ১ পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন এবং বোর্ড সদস্য (একাডেমিক এফেয়ার্স) পরিকল্পনাবিদ উসওয়াতুন মাহেরা খুশি।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন যে, বাংলাদেশের বৈষ্যতা দূর করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রতন্ত্রের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে কাজ করছে ১১টি কমিশন। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নগর অঞ্চলকে সবথেকে বেশি অগ্রাধীকার দেওয়া উচিত, অন্যথায় দেশের উন্নয়নের অগ্রগতি পূর্বের মতোই পরিচালনা হবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিভিন্ন পেশাজীবিদের মাঝে সব থেকে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নগর পরিকল্পনাবিদরা। কেননা সকল জায়গাতেই বলা হয়, পেশাজীবী হিসেবে আমরা মাল্টিডিসিপ্লিনারি কাজ করি, অথচ দেখা যায় নগর পরিকল্পনাবিদদের উপযুক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। বিআইপি স্থানিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে যেটা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রতন্ত্রের সাথে কাজ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এটি পৌছাতে না পারলে দেশ ও দেশের মানুষ বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ হিসেবে "বাংলাদেশে নগর / স্থানিক পরিকল্পনার পদযাত্রা: অতীত, বর্তমান ও আগামীর করনীয়" উপস্থাপিত হয়। এখানে মূল ধারা গুলো উপস্থাপন করেন বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ উসওয়াতুন মাহেরা খুশি এবং প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ করেন বিআইপি সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন। সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন যে, বিগত অর্ধশতাব্দী কাল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তবে জন আকাংখা তথা ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ গঠনে সাম্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুষম উন্নয়ন কাঙ্খিত মাত্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এজন্য রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার পাশাপাশি কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কাঠামোগত বিষয়ও জড়িত। সঠিক স্থানিক পরিকল্পনা অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, বৈষম্য নিরসন পূর্বক সকল এলাকার মানুষের জন্য সম্পদের ব্যবহারসহ সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটি পরিকল্পনা পেশার অন্যতম মানবিক দিক। দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশ একটি সংস্কারাচ্ছন্ন কাঠামোগত ঘূর্ণণের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে। জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগ আমাদের সামনে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্র ও তার জনগণের জন্য যা কছু কল্যাণকর তা গ্রহণ করার।

ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার জনাব শরফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী বলেন,পরিকল্পনাগুলো তথ্য নির্ভর হওয়ার কারণে বাস্তবায়নের সময় বিভিন্ন ধরনের অসম্পূর্নতা পাওয়া যায়। ফলে প্লান গুলো বাস্তবায়নের সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখাপেক্ষী হতে হয়।পূর্বের সকল পরিকল্পনাগুলো হতো গ্রামীণ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যার ফলে ঢাকা শহরের মতো জায়গা গুলো অপরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে। ফলশ্রুতিতে এখন শহরের সমস্যা দূরীকরনের উদ্দেশ্যে নতুন পরিকল্পনায় ড্রেন করার যায়গা নেই, ভবনে গাড়ি ঢোকার রাস্তা নেই। সুতরাং ধাপে ধাপে উন্নয়ন করতে হবে তবেই নগরের পরিকল্পনাগুলো যথার্থ অর্থে বাস্তবায়ন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজউক চেয়্যারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অবঃ) বলেন, আমাদের দেশে কেউ আইন মানতে চায় না। আমি "চ্যাম্পিয়ান" এই ক্যালচার থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে সম্বনিতভাবে কাজ করার জন্য রাজউক উদ্যেগ নিয়েছে। তিনি জানান,নতুন শহরগুলোতে রাস্তা অনেক প্রশস্ত হবে, বহুতল ভবন করা হবে যেন মূল শহরে মানুষের চাপ কমানো যায়, এবং জলাশয়গুলো সংরক্ষণ করা হবে যেন কেউ রাতের অন্ধকারে দখল করতে না পারে। নতুন বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিককে সাথে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে শহিদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয় এর মা  মোছা: সামছি আরা জামান বলেন, দেশের স্বার্থে আইন প্রয়োগ করতে হবে। শুধু সভা- সমাবেশ করলেই হবে না,দায়িত্ব পালন করতে হবে।আমরা এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই,যেখানে বৈষম্য থাকবে না।

দেশে পরিকল্পনার গুরুত্ব না থাকায় আজ এত অব্যবস্থাপনা বলে মন্তব্য করেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড এর ইমেরিটাস অধ্যাপক এ টি এম নুরুল আমিন। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের আবাসন কাঠামো নেই, উন্মুক্ত জায়গা নেই, খেলার মাঠ নেই। পলিসিকে জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হলে,পরিকল্পনাবিদদের সংযুক্ত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় “নগর পরিকল্পনা” যুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি পরিকল্পনা পেশার গুণগত মান বাড়াতে বেশী বেশী গবেষণা করা,এবং তার ফলাফল প্রকাশ করার পরামর্শ দেন।

বিআইপির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান এদেশের পরিকল্পনার দুরবস্থা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ৫০ বছর পার হলেও এখনও পর্যন্ত সেই অনুপাতে প্ল্যানিংকে দেশের সর্বস্তরে পৌছানো সম্ভব হয়নি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরিকল্পনাবিদদের প্রচেষ্টা, প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সর্বোপরি দেশকে এগিয়ে নিতে নির্দেশনা দেন তিনি।

বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্যই মূলত পরিকল্পনা প্রয়োজন, পরিকল্পনাবিদের জন্য না। নিজের সন্তানের জন্য খেলার মাঠ, পড়ার টেবিলে আলো বাতাসের ব্যবস্হা না থাকলে, সেটা তার অভিভাবকের চিন্তার বিষয়। শহরের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার আছে এসব সুবিধা পাওয়ার, সন্তানের মানবিক বিকাশের পরিবেশ পাওয়ার। সামগ্রিক পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটানোর পেছনে তিনি কতিপয় অসাধু আর্কিটেক্ট ও সিভিল ইন্জিনিয়ারের ব্যবসায়ীক মনোভাবকে দায়ী করেন। রিহ্যাব যদিও আবাসনের ব্যবস্হা করে থাকে, সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য তাদের কোন উদ্যোগ নাই। তিনি সকলকে অনুরোধ করেন, নিরাপদ ও স্বাস্হ্যকর গ্রাম ও শহর নিশ্চিত করতে সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে দাবি আসতে হবে। মানুষ যদি নিরাপদ শহর চায়, তাহলে দেশও পরিকল্পিত হবে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বিআইপি সভাপতি অতিথিদের হাতে সম্মননা স্মারক তুলে দেন।

অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে অনেকের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নগর উন্নয়ন অধিপ্তরের জ্যেষ্ঠ পরিকল্পনাবিদ শরিফ মো: তারেকুজ্জামান এবং ইঞ্জিনিয়ার মো: নুরুঊল্লাহ। শরিফ মো: তারেকুজ্জামান  তার বক্তব্যে বলেন, শ্রীলঙ্কা ,জাপান ,মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা আছে, যা  জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানিক ৩ পর্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটা দেশের পরিবেশের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এসকল পরিকল্পনা তৈরি হয়ে আসছে।  কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা বরাবরই অবহেলিত। সেক্টরাল প্ল্যানগুলো একত্রিত করা, নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ কার্যক্রম নিতে সাহায্য করা, ও পরিবেশকে বাচাতে এই সমন্বিত স্হানিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।