08 Nov 2024
বিআইপির সুবর্ণ জয়ন্তী ও বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বর্ণাঢ্য র্যালি
বৈশ্বিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নিতে সারাদেশের জন্য ভূমি ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পেশাজীবীদের যথাযথ সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়াও প্রতিটি নগরের জন্য নির্ধারিত মহাপরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে যথেচ্ছা ভূমি ব্যবহার প্রতিনিয়ত দেশের নগরগুলোতে হুমকির সম্মুখীন করছে। যথাযথ স্থানসমূহে পর্যাপ্ত নগর পরিকল্পনাবিদদের সংশ্লিষ্টতার অভাবের কারনে মহাপরিকল্পনা সমূহ বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এসকল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সারাদেশের জন্য একটি সমন্বিত স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের প্রতিটি পর্যায়ে পরিকল্পনাবিদের পদয়ান নিশ্চিত করতে নীতি নির্ধারকদের যথাযথ পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে বিআইপির সুবর্ণ জয়ন্তী ও বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘বর্ণাঢ্য র্যালি’তে বক্তবারা এমন মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের উদ্বোধনী অংশ হিসেবে পৃথিবীকে পরিকল্পিত ও মানুষের বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এবং নগর পরিকল্পনার চিন্তা-চেতনা ও গুরুত্বকে সারা বিশ্বে পরিচিতকরণের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় এবছরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ৮ ও ৯ নভেম্বর ২০২৪ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এবারের বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সমগ্র দেশের পরিকল্পনা করি, বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ গড়ি’।
এরই ধারাবাহিকতায়, অদ্য ৮ নভেম্বর ২০২৪ (শুক্রবার), সকাল ৮:৩০ টায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বিআইপির উদ্যোগে একটি ‘বর্ণাঢ্য র্যালি’ আয়োজন করা হয়। র্যালিটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে রাজু ভাস্কর্য হয়ে শাহবাগ চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। আয়োজিত এ র্যালিতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ রেজাউল করিম।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান এর সঞ্চালনায় র্যালির শুরুতে কেন্দ্রীয় শহীদ মীনার প্রাঙ্গনে উদ্বোধনী ঘোষনা এবং পরবর্তীতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে একটি সংক্ষিপ্ত পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগত বক্তব্যে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক বলেন, রাষ্ট্র সংষ্কার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। তিনি সারাদেশের স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের উপর গুরাত্বারোপ করে বলেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেশের প্রতিটি স্তরে, প্রতি ইঞ্চিতে সকল জনগণের দোরগোড়ায় পরিকল্পনার সুফল পৌছানো আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত।
বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বিগত ৫০ বছরে বিআইপির সাথে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। অপরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক অবকাঠামো তৈরি, যেমন পরিকল্পনা ছাড়াই হাওরের মাঝে রাস্তা, পাহাড় কেটে রেললাইন তৈরি করা কে তিনি সমন্বিত স্থানিক পরিকল্পনার অভাব বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের ভৌত পরিকল্পনা করার কথা হলেও, সেটি বাস্তবায়ন হয়নি এখন পর্যন্ত। পরিকল্পিত দেশ তৈরির জন্য স্থানিক কাঠামো পরিকল্পনা দরকার। পরিকল্পনাবিদদের শহর থেকে নগর সব জায়গাতেই অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার। সমগ্র বাংলাদেশের কোনো পরিকল্পনা তৈরী করা হয়নি এখন পর্যন্ত। কিন্তু আমরা চাই, পুরো বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা, নাগরিক এলাকায় নাগরিক সুবিধা দেওয়া ও খাল-বিল ভরাট করে শিল্পায়ন বন্ধ করা।
শুরুতেই বিআইপির সুবর্ণ জয়ন্তী ও বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস ২০২৪ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিআইপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পরিকল্পনাবি অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান। এসময় র্যালিতে উপস্থিত বিশেষ অতিথিগণ সকলেই বিআইপির সুবর্ণজয়ন্তী এ মহেন্দ্রক্ষণে বিআইপির ৫০ বছরের পথচলা এবং দেশের টেকসই উন্নয়নে বিআইপির ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করেন এবং সকল স্তরের সকল অংশীজনকে বিআইপির পাশে থেকে পরিকল্পিত ও টেসকই বাংলাদেশে বিনির্মাণে বিআইপির অগ্রযাত্রায় অংশ নেয়ার আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. আনিসা নূরি কাকন বলেন, পরিকল্পনা ও উন্নয়নের পার্সপেক্টিভে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ঢাকা, চট্টগ্রাম,বা খুলনার পাশাপাশি, গ্রামীণ এলাকারও পরিকল্পনা করতে হবে। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোঃ আসিফ উজ জামান খান বলেন, উন্নয়ন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক না করে, সুষমভাবে করতে হলে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। বিআইপির সাবেক সহ-সভাপতি ড. মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় দেখা যাচ্ছে, সেখানে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে পরিকল্পনাবিদদের যথাযথ কাজ করার সুযোগ দেওয়া হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাবেক সাধারণ সম্পাদ পরিবেশকর্মী জনাব শরিফ জামিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য পদ ফাঁকা আছে, যেখানে পরিকল্পনাবিদদের নিয়োগ দেয়া অতি জরুরি বলে মন্তব্য করে সঠিক পরিকল্পনার অভাবকে দেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারন হিসেবে উল্লেখ করেন। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর পরিচালক গাউস পিয়ারি বলেন, নগর পরিকল্পনার সাথে রাষ্ট্র পরিকল্পনায়ও পরিকল্পনাবিদদের সুযোগ দিতে হবে। এসময় বক্তারা আরও বলেন, নগরকেন্দ্রিক পরিকল্পনার পাশাপাশি সারাদেশের জন্যও স্থানিক পরিকল্পনা করতে হবে। সাথে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক উন্নতি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
র্যালির পরবর্তী অংশে রাজু ভাস্কর্যের নিকট পৌঁছে পরিকল্পনাবিদেরা অবস্হান গ্রহণ করেন এবং এসময় একটি সংক্ষিপ্ত পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পথসভায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রতিনিধিরা বক্তব্য প্রদান করেন। কৃষি জমি থেকে শুরু করে গ্রাম-শহর ও দেশের প্রতিটি ইঞ্চির স্হানিক উন্নয়ন পরিকল্পনা থাকা দরকার বলে উল্লেখ করা হয়। তরুণ সমাজ ও বিভিন্ন অ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা বলেন, দেশে অসংখ্য প্রজেক্ট চলছে, কিন্তু সমন্বিত স্হানিক পরিকল্পনার অভাবে এর কোনটিই জনগনের সমস্যার সমাধান করতে পারছেনা। এমনকি সরকারভেদে বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হলেও, সেগুলো সফল না হওয়ার পেছনে এই সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব ছিল। এর পাশাপাশি দেশের সকল পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রতিটি শহর ও উপজেলায় পরিকল্পনাবিদের প্রয়োজন মেটানোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।
পরিকল্পনাবিদ তাপস বালা বলেন, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত দেশের পরিকল্পনায় আমাদের সাথে এগিয়ে এসে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআইপি স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার প্রতিনিধি বলেন, উন্নতশীল বাংলাদেশে এখন যথার্থ পরিকল্পনা দরকার এবং এই পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই সমন্বিত পদ্ধতিতে তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনাবিদরা নাগরিক সমাজের নগর মান নিশ্চিত করতে চায়। এই পরিকল্পনার সুফল যেন সকল স্তরে পৌছায়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য যারা নাগরিক দের নিয়ে কাজ করছেন তাদের অনুরোধ জানানো হয়। একজন বক্তা বলেন, আমাদেরকে বিভিন্ন উচ্চমহল দিনের পর দিন ব্যর্থ ও অপ্রয়োজনীয় বলে আসছে। এই দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনাবিদদের গুরুত্ব তুলে ধরতে ছাত্রদের কাজ করতে হবে।
বিআইপি আয়োজিত এ বর্ণাঢ্য র্যালিতে পেশাজীবী পরিকল্পনাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পরিকল্পনবিদদের বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক অ্যালামনাই প্রতিনিধি, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধি সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।