Seminar

30 Oct 2024

বিআইপির উদ্যোগে আয়োজিত “বাংলাদেশের নগর এলাকার আবাসন পরিকল্পনার সংস্কার ভাবনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভা


World Cities Day 2024 (বিশ্ব নগর দিবস ২০২৪) এবং World Habitat Day 2024 (বিশ্ব বসতি দিবস ২০২৪) উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর উদ্যোগে বিগত ২৯ অক্টোবর ২০২৪ (মঙ্গলবার), সকাল ১০.৩০ টায় পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে “বাংলাদেশের নগর এলাকার আবাসন পরিকল্পনার সংস্কার ভাবনা” শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা সভা বিআইপি কনফারেন্স হল এ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় বাংলাদেশে সবার জন্য বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়সঙ্গত, সুপরিকল্পিত এবং টেকসই নগর আবাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে অংশীজনদের মতামত ও অভিমত বিনিময় করা হয়। বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান এর সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ইনস্টিটিউট এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

গোলটেবিল আলোচনা সভায় পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশ্বব্যাপী অক্টোবর মাসকে “আরবান অক্টোবর” বলা হয় কারণ এই মাসেই একইসাথে ওয়ার্ল্ড হ্যাবিটেট ডে, ওয়ার্ল্ড সিটিস ডে এবং ওয়ার্ল্ড টাঊন প্ল্যানিং ডে পালন করা হয়। জুলাই বিপ্লবের পর চারিদিকে সংস্কারের বাতাস লাগলেও আমাদের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক একটি চাহিদা, আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে আমরা আজো উদাসীন। তিনি আরো মন্তব্য করেন, নতুন বাংলাদেশের আবাসন মডেল কি রকম হবে, কারা আমাদেরকে এই রূপরেখা তৈরী করে দিবে, আমাদের তা জানা দরকার। আমরা যে আবাসনের স্বপ্ন দেখি তা কি আমরা গত ২০-৩০ বছরে করতে পেরেছি , আমরা কি এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্যে উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করবো নাকি আমাদের কমিউনিটি, মানুষের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা করবো তার ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতিকে বিবেচনা করে আবাসন পরিকল্পনা করতে হবে। পাশ্চাত্যের কোন মডেল, আমাদের পরিকল্পনার মডেল হবে না। শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে দেশ ধ্বংস হতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, সংবিধান মোতাবেক আমাদের ৫টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে আবাসন অন্যতম হলেও এর সংস্কারে আমরা উদাসীন। শহরের সুযোগ-সুবিধা বেশী হওয়ায় গ্রামের মানুষ বেশী শহরে আসছেন। পরিকল্পনাবিদকেই আবাসন সমস্যার সমাধান করতে পরিকল্পনা কৌশল ঠিক করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পঞ্চম শেণী থেকে নগর পরিকল্পনাযুক্ত করতে হবে। পরিকল্পনাবিদদের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় আজ আবাসন পরিকল্পনার এ অবস্থা বলে দাবী করেন।

এইচবিআরসি'র নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আবু সাদেক, পিইঞ্জ বলেন, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০% মানুষ শহরে বাস করলেও আমরা এই জনসংখ্যার কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠি নিয়ে চিন্তা করি।বস্তিতে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী আমাদের পরিকল্পনার কেন্দ্রে কখনোই থাকে না। তিনি আরো বলেন, ঢাকা অঞ্চলে আমাদের পর্যাপ্ত কোন পরিকল্পনা নাই তাই আমাদেরকে সংস্কারের আগে টেকসই একটি রূপরেখা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। তাছাড়া এই রূপরেখা বাস্তবায়নে আমাদের যে বস্তিতে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদেরকে এর কেন্দ্র রেখে চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, আবাসনের নতুন রূপরেখা তৈরীতে আমাদেরকে নগরীর জনঘনত্ব, সবুজায়ন ও উন্মুক্ত স্থান এবং পরিবহন ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। তাছাড়া ন্যাশনাল হাউসিং পলিসিতে দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়াদি যুক্ত করার পাশাপাশি ড্যাপ , ইমারত নির্মান বিধিমালা এবং স্ট্রাকচার প্ল্যানকে সংযুক্ত করতে হবে। জাতীয় আবাসন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বিভাগীয় শহরের জন্যে তাদের  অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির উপর জোর দিয়ে আবাসন রূপরেখা তৈরী করতে হবে। তাছাড়া মোট জাতীয়  বাজেটের শতকরা ৫% আমাদের আবাসন খাতে বরাদ্দ করার পাশাপাশি , আবাসন খাতে গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর জাতীয় আবাসন দিবস পালনের জন্যে সরকারকে তিনি আহবান জানান।

বুয়েট এর নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী মধুমিতা আক্তার বলেন, ঢাকার আবাসন ভবনগুলোর মিশ্র ব্যবহার শিশুসহ সবার সামাজিকীকরণে বাধা দিচ্ছে। তিনি সাশ্রয়ী আবাসনের অতিরিক্ত খরচ কমানোর এবং ছাদগুলোকে খালি রাখার দাবি জানান।

হ্যাবিটেট ফর হিউমিন্যাটির জুলিয়েট রোসেট বলেন, শহরে বাস করা অনেকের জন্যই প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধাদি নেই। তিনি আবাসন পরিকল্পনায় গ্রিন হাউজিং, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনারপ ওপর জোর দিয়েছেন।

সিসিডিবি প্রধান মো. ফয়েজ উল্লাহ তালুকদার জানান যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ছে তাই ঢাকার আশেপাশের এলাকাসমূহকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। এতে শহরের চাপ কমবে।

ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর পরিচালক গাউস পিয়ারি বলেন যে, শহরে সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। কেননা সেই বাচ্চাগুলো জানেনা তারাও বড় হয়ে সরকারের কাজের সাথে যুক্ত হয়ে ভুমিকা রাখবে, তারাও চাইলে বড় মানুষ হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগ এর সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, সংস্কার মানে ভেঙ্গে দেয়া বা ফেলা দেয়া এই মানষিকতার পরিবর্তন করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের ফ্ল্যাটবাবদ  উচ্চ ডিপোজিট ও কিস্তির টাকা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান বাধা। প্রকল্প সুবিধাভোগী মানুষজন এর সক্ষমতা অনুযায়ী কিস্তির টাকা নির্ধারণ করা দরকার। পলিটিক্যাল চক্র ও আমলা চক্র কিভাবে কাজ করে,সেটি দেখা প্রয়োজন। বস্তির মানুষের ইনক্লুশন কেড়ে নেয়া যাবে না। ডিকনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে আবাসন পরিকল্পনার প্রকৃত সংস্কার সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রকৌ. পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ নুরূল্লাহ বলেন, ভূমিজোনিং এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে করা হয় নি। আইন প্রয়োগের জন্য বিআইপি থেকে টাস্ক টিম গঠনের প্রস্তাব করেন। নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান ইবনুল সাইদ রানা এতদিনেও বাংলাদেশের জন্য জাতীয় আবাসন পরিকল্পনা না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বড় ধরণের দূর্যোগ ঘটার আগেই  নগর এলাকার জলাশয় জলাধার ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ, জাতীয় আবাসন নীতিমালার বাস্তবায়ন,ও প্লট বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ আন্দোলন সংগঠক কর্মী আমিরুল রাজীব ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানি কীভাবে যোগান হয়, তা দেখার প্রয়োজন তুলে ধরেন। আবাসন নীতি ভাবার আগে, প্রাণ-প্রকৃতির কথাও ভাবতে হবে। দূষণ কমাতে না পারলে, প্রকৃত অর্থে কোন সংস্কার হবে না বলে দাবী করেন। পরিকল্পনাবিদ আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ঢাকায় মতো উচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সঠিক পলিসি না থাকার জন্য আবাসনে আজ এত সমস্যা বলে মন্তব্য করেন।