Press Conference

05 Sep 2024

বিআইপি আয়োজিত ‘পরিকল্পিত ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন এবং টেকসই পরিকল্পনা চর্চায় স্বার্থান্বেষী মহলের আগ্রাসন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন


ড্যাপ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর পরিকল্পনা পূর্বেও ছিলো এখনো আছে। বসবাস উপযোগিতার বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে। ড্যাপের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পরিমার্জন করা যেতে পারে। রাজউকের বিদ্যমান দুর্বল প্রশাসন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর চাপে পড়ে নমনীয় হবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা টেকসই নগর গড়বার লক্ষ্যকে বিপর্যস্ত করবে। 

বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রিহ্যাব ও স্থপতি ইনস্টিটিউট এক সুরেই বলছে, এ ড্যাপ বিগত সরকারের আমলে প্রণীত এবং বৈষম্যমূলক, তাই এর সংস্কার প্রয়োজন, এটা বাতিল করতে প্রধান উপদেষ্টাকে জানাতে হবে। স্বার্থগোষ্ঠী নিজের স্বার্থে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে কিভাবে নিজের রুপ ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে উপরোক্ত মহলের ড্যাপ বাতিলের দাবী এক জাজ্বল্যমান উদাহরণ। এই অবস্থায় বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল করে আগের ড্যাপ এবং ইমারত নির্মাণে ফিরে গেলে ঢাকার বাসযোগ্যতার আরও কমে যাবে। রাজউকের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের একটি গ্রুপও ড্যাপের বিরোধিতা করছে। এর পেছনে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র উদ্যোগে ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বুধবার), সকাল ১১.০০ টায় রাজধানীর বাংলামটরস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স হলে আয়োজিত ‘পরিকল্পিত ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন এবং টেকসই পরিকল্পনা চর্চায় স্বার্থান্বেষী মহলের আগ্রাসন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে আসে। উক্ত অনুষ্ঠান সঞ্চালনা এবং প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। 

সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপে বন্যা প্রবাহ এলাকা ও কৃষি জমি সংরক্ষণ এবং মিশ্র ব্যবহারের অতিরিক্ত সুযোগ বাতিল - প্রভৃতি সুস্পষ্ট দাবীর ব্যাপারে বিআইপি ইতিপূর্বেই দাবী করে এসেছে এবং এই দাবীসমূহের প্রতি সুস্পষ্ট অবস্থান পূনর্বার ব্যক্ত করছে। আমরা মনে করি আবাসন ব্যবসায়ীসহ স্বার্থান্বেষী মহলের চাপেই ড্যাপে উপরোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ড্যাপ পূনর্মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাধার, কৃষিভূমি-জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু ঢালাওভাবে ড্যাপ বাতিলের দাবী অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক এবং পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন এর সুস্পষ্ট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

আবাসন ব্যবসায়ীরা কেবল উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট তৈরী করেন,কালো টাকা সাদা করার জন্যে আবাসনের কৃত্রিম চাহিদা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনাবিদ শাহরিয়ার আমিন।
পরিকল্পনাবিদ সালমা এ. শফি বলেন, আজকাল ঢাকা শহরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অনেক ভবন নির্মাণ হচ্ছে, এর জন্য ভূমি ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। জনগণের স্বল্প আয়ের আবাসন প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রকৌশলী আবু সাদেক বলেন,পরিকল্পনবিদরাই পরিকল্পনা করবে। আর যারা পেশাদারীত্বের বাইরে নিজেকে পরিকল্পনায়যুক্ত করেছে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করেন। দুর্বৃত্তরা যদি কোন পরিকল্পনার পক্ষে থাকে তাহলে তা আম-জনতার পক্ষে নয়। বর্তমান অন্তরবর্তীকালীন সরকার এসট্যাবল না হতেই ড্যাপ বাতিল চাওয়া ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেযুক্ত ছাত্র-জনতাকে পাশে থাকার আহ্বান জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতা সাজিদ ইকবাল বলেন, আমরা কিছুদিন আগে যে আন্দোলন করেছি সেটি ছিলো মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূরকরণের আন্দোলন। কিন্তু বৈষম্য শুধু মানুষের মধ্যেই হচ্ছেনা, বৈষম্য হচ্ছে শহর ও প্রকৃতির সাথেও কারণ DAP এ আছে বৈষম্য। 

অপর ছাত্রনেতা ইয়াসির আমিন বলেন, শহরের কোন অনিয়ম দেখা গেলে অথবা বাসিন্দারা কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে সকলে অপরিকল্পিত নগরায়ন কে দায়ী করে, কিন্তু এই অপরিকল্পিত নগরায়নের অন্তরায়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী দায়ি রয়েছে আমাদেরকে জনগণকে তা বুঝাতে হবে। 

বিআইপির কোষাধ্যক্ষ পরিকল্পনাবিদ ড. মুঃ মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, ২০১০ এর ড্যাপ প্রণয়নের পর রিভিউ করে প্রথম দুটি প্রকল্প নেয়া হয় মূলত পানির ওপর। বসুন্ধরার সব প্রকল্প পাস হয়, ঋণের বোঝা বাড়ে জনগণের, কালো টাকা আবাসন প্রকল্পে নিয়ে সাদা করার ব্যবস্হা করা হয়। এভাবে অসৎ উপায়ে আর্টিফিশিয়াল ডিমান্ড তৈরি করে ৭০ লাখের ফ্ল্যাট ১.৫ কোটিতে বিক্রি হয়। 
বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ড্যাপে ভূমি ব্যবহার ,আবাসন, পরিকল্পনা ও যোগাযোগ, নগরের সৌন্দর্য বর্ধন নিয়ে আলোচনা করা হলেও স্বার্থন্বেষী জনগোষ্ঠী শুধুমাত্র বিল্ডিংয়ের উচ্চতা বাড়ানোর জন্যে ড্যাপ বাতিলের দাবি জানাচ্ছে।এই জনগোষ্ঠী শহর বলতে শুধুমাত্র বাড়ী বানানোকে বুঝে, জনগণের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যে যে আলো বাতাসের প্রয়োজন তারা এই ব্যাপারে পুরোই উদাসীন। 

বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদ আহ্বায়ক পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকার কালুনগর খাল,মান্ডা খাল দখল করে আবাসন ভবন গড়ে উঠেছে ,গত ৫৩বছরে জলাধারগুলো রক্ষা করা হয় নি। ড্যাপে ৮তলার বেশী ভবন করা যাবে না,এটিকে ভুল মন্তব্য বলে আখ্যা দেন। এছাড়াও স্বাধীনতার ৫৩বছর পরেও নগর উন্নয়ন আইন নেই,যা খুবই প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।

বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম বলেন, শহরে বাসযোগ্যতা বাড়াতে নাগরিক সুবিধা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈষম্য দূর করার জন্য সারাদেশের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করতে হবে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য DAP মেনে চলতে হবে।

সাংবাদিকদের মধ্য থেকে অংশগ্রহণ করেন সামছুর রহমান, সাইফুল মাসুম প্রমুখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ উসওয়াতুন মাহেরা খুশি, পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ, পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদীন, সাবেক সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম প্রমুখ।

পরিকল্পিত ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন এবং টেকসই পরিকল্পনা চর্চায় স্বার্থান্বেষী মহলের আগ্রাসন বন্ধ করতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)র প্রস্তাবনাঃ
  • বিগত সময়ে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিকল্পনায় যেসকল পরিবর্তন করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সঠিক তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবার উদ্যোগ গ্রহণ।
  • পরিকল্পনা, ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়ায়  স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ব্যবস্থা গ্রহণ।
  • পরিকল্পনা প্রণয়নে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের অনৈতিক প্রভাবকে দূর করে পরিকল্পনাবিদদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সুযোগ করে দেয়া।
  • ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাতিলের দাবীর মাধ্যমে পরিকল্পনাবিহীন উন্নয়নের পেছনে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের ব্যবসায়িক ও গোষ্ঠীস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকর অনুসন্ধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
  • মহাপরিকল্পনা সহ বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের অবৈধ প্রভাব বন্ধ করা এবং বল প্রয়োগ কারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া।
  • অনুমোদিত ভূমি ব্যবহার এর ব্যত্যয় করে আবাসন- শিল্প কারখানা গড়ে উঠবার পেছনে গোষ্ঠীস্বার্থের প্রভাব অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
  • দেশের পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন এর স্বার্থে নগর ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থাসমূহের পরিকল্পনাবিদ পদসমূহে পরিকল্পনাবিদদের পদায়ন নিশ্চিত করা।
  • দেশের পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন এবং মহাপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও আইনের বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ত আবাসন ব্যবসায়ী, শিল্প কারখানার মালিক, রাজনীতিবিদ, আমলা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থাসমুহের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।
  • সঠিক গবেষণার মাধ্যমে নগর এলাকার আবাসনের প্রকৃত চাহিদা নিরুপণ করে প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান ও আবাসন সংক্রান্ত কর্মকৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও জাতীয় আবাসন কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
  • পরিকল্পনা দলিলকে অনুসরণ করেই যেন অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন তৈরি, নাগরিক সুবিধাদির সংস্থান হয়; সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের চাপে পরিকল্পনা দলিল ও আইন পরিবর্তন করবার অতীত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবার কোন সুযোগ নেই।
  • মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ও পূনর্মূল্যায়নে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদির সুষম বন্টন, এলাকাভিত্তিক সাম্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাধার, কৃষিভূমি-জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত।