11 Aug 2024
‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পরিকল্পনাবিদদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক বিআইপির সংবাদ সম্মেলন
২০২৪ সালে বাংলাদেশের ছাত্র -জনতার গণ আন্দোলনের মাধ্যমে জাতির সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ আগস্ট গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, জবাবদিহিতামূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ার প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর কাছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের আহ্বান থাকবে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পেশাজীবীদের যথাযথ সম্পৃক্ততা, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি, ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণার বিকেন্দ্রীকরণ, সকল দখলকৃত নদী, খাল, পার্ক, খেলার মাঠ অনতিবিলম্বে উদ্ধার করে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, এবং পাবলিক যানবাহন, ফুটপাত এবং রাস্তাঘাট বয়স্ক, শিশু, শারীরিক অক্ষম, গর্ভবতী নারী এবং নারীবান্ধব করার প্রতি পরিকল্পনাবিদেরা গুরুত্ব আরোপ করেন। গত ১০ অগাস্ট ২০২৪ (শনিবার) তারিখে রাজধানীস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারে বিআইপি আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পরিকল্পনাবিদদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এই কথাগুলো বলেন।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, একটা নগরকে কীভাবে গড়তে হয়, কীভাবে নিয়মের মধ্যে আনতে হয় সেটা শিক্ষার্থীরা যেভাবে জাতিকে শিখিয়েছে, সেভাবে জাতিকে আর কেউ শেখাতে পারেনি কখনো। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য পুনরুদ্ধার, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীন পরিচালনা, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সকল এলাকার জন্য নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন; এই সকল পরিকল্পনা দলিলকে অনুসরণ করে সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং এতদসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের পুনর্গঠন করা দরকার। এছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক এবং স্থানিক (নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ) উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে ও বাস্তবায়নে জন্য উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি এবং পেশাজীবীদের যথাযথ সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা এবং এতদ্ সংক্রান্ত গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দেশের সকল স্তরের যে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে বাসযোগ্য বাংলাদেশে বিনির্মাণের দর্শন ঠিক করতে হবে। এসব পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান ও চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার পাশাপাশি টেকসই নগর ও বসতির বিকাশ, কৃষি জমি রক্ষা, ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণে জোর দেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে দেশের সকল দখলকৃত নদী, খাল, পার্ক, খেলার মাঠ অনতিবিলম্বে উদ্ধার করে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও তিনি সকল সামাজিক ও স্থানিক অবস্থানের মানুষের সমতা নিশ্চিত করা, বিশেষ (এডহক) প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন পদ্ধতি পরিহার করে স্থানিক পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জোর দেন। সকল ধরনের নীতি নির্ধারণ এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যথাযথ ব্যাবস্থার অন্তর্ভূক্তি করা দরকার। পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের প্রতিও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
বিআইপির সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বর্তমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজানো, বহুতত্ববাদ চর্চা করা, শোষণ ও বৈষম্য দূর করতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, এবং স্থানিক পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দেন। এছাড়াও মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে চাইলে সরকার ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের কথা বলেন, যেখানে রয়েছে তিন স্তর বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা। সুতরাং সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও হবে তিন স্তর বিশিষ্ট। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ হবে নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ন করবে প্রদেশিক এবং স্থানীয় সরকার। তাহলেই দেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। এবং ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে সকলের।
জুলাইয়ের বিপ্লবে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন সেইসকল শহীদদের আত্মত্যাগকে স্বরণ করে বিআইপির কোষাধ্যক্ষ পরিকল্পনাবিদ ড. মুঃ মোসলেহ উদ্দীন হাসান তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, সুষম নগরায়ণের জন্যে ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণার বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের আঞ্চলিক পর্যায়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করবার পরিকাঠামো ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা দরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যকে আমলে নিয়ে সুষম উন্নয়ন দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে এডিপির বরাদ্দ দেয়া ও জেলাভিত্তিক বাজেট কাঠামো প্রণয়ন করার জন্যে তিনি নীতিনির্ধারকদের আহবান করেন। তাছাড়া ঢাকা শহর সহ পুরো দেশের মানুষজন যেনো সকল উন্নয়নের সেবা ভোগ করতে পারে তার জন্যে রাইট বেইসড এপ্রোচকে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে ঢাকা শহরে গণপরিবহনের মাধ্যম হিসেবে বাস ব্যবহারের পরিমাণ ৫০% কমেছে যা ঢাকার মতো একটি মেগা শহরের সুষম নগরায়ণের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। ন্যায্য নগরায়ণের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক কর্তৃক পরিকল্পনার জন্যে পরিকল্পনাবিদদের কে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। যার কারণে আমাদের দেশের কাঠামোগত বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিআইপির সাবেক সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম বলেন, জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেয়া, প্রকল্প গহণে বৈষম্য দূর করা ও সার্বজনীন প্রকল্প গহণ করা, প্রকল্পের লোকেশন গ্রহণে বৈষম্য দূর করা এবং রাতের অন্ধকারে প্রকল্প গ্রহণ না করে জনগণের প্রয়োজনে প্রকল্প নেয়া প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সুশাসন বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব না। দেশের বেশি সংখ্যক মানুষকে সুবিধা দিতে হবে। খেলার মাঠ, ফাঁকা জায়গা এবং পার্ক উন্নয়নের নামে ধংস করা যাবেনা। `গ্রাম হবে শহর’ বলে গ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা যাবেনা। এই জিনিসগুলো আগে পরিকল্পনাবিদরা বললেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হতোনা। যেহেতু বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব, তাই সুশাসনের মাধ্যমে কম খরচে অধিক উন্নয়নের দিকে আমাদের হাঁটতে হবে।
একটি সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন, জবাবদিহিতামূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সকল অংশীজনের ন্যায় পরিকল্পনাবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অব্যাহত সহযোগিতা প্রদানে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআইপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ হোসনেআরা আলো, পরিকল্পনাবিদ মোঃ আবু নাইম সোহাগ, পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদীন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী জনাব মোঃ নুরুল্লাহ প্রমুখ।