04 Jul 2024
বিআইপি’র সংবাদ সম্মেলন “বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে”
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বিগত সময়ে বড় ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নগর সুশাসন, উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের কার্যকর সমন্বয়, সেবা সংস্থাসমুহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, উন্নয়ন পরিকল্পনায় কমিউনিটির অংশগ্রহণ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোতে। ঢাকার যানজট এবং বায়ু, পানিসহ পরিবেশদূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাশ্রয়ী, কার্যকর ও টেকসই সমাধান বের না করতে পারলে ঢাকা বাসযোগ্য হবে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র উদ্যোগে অদ্য ০৩ জুলাই ২০২৪ (বুধবার), সকাল ১১.০০ টায় রাজধানীর বাংলামটরস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স হলে “বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে” শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠানে উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে আসে। বিআইপি সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পরিবেশন করেন বিআইপি সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় নাগরিক সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পাশাপাশি নগরে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী জনঘনত্ব যত হওয়ার কথা তার চেয়ে তিন-চারগুণ জনসংখ্যা এই শহর ধারণ করছে। ফলে শহরে বাসযোগ্যতার উন্নতি হচ্ছে না। তবে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন নগর সংস্থাসমুহের উদ্যোগ আছে, যার মাধ্যমে নতুন করে নাগরিক সুবিধা তৈরি করা হয়। কিন্তু নতুনভাবে যুক্ত সুবিধার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হারে নতুন মানুষ ঢাকা শহরে নানা প্রয়োজনে আসে। ফলে নাগরিক সুবিধা ও মোট জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে নগরী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মেট্রোরেলের পাশাপাশি গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এর জন্য মানসম্মত বাস সার্ভিস ও প্যারা ট্রানজিট সার্ভিস নিশ্চিত করা এবং হাটবার উপযোগী ফুটপাত নিশ্চিত করতে হবে। এলাকাভিত্তিক সবার জন্য প্রবেশগম্য খেলার মাঠ - পার্ক- উদ্যান তৈরি করা এবং বিদ্যমান সুবিধাবাদীসমূহ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা দরকার। এছাড়া আবাসিক এলাকায় পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে পরিকল্পনার মানদন্ড (প্ল্যানিং স্ট্যান্ডার্ড) সংশোধন করা, আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীন শিল্প কারখানা-গুদাম প্রভৃতি সরানোর উদ্যোগ নেয়া, প্রয়োজনমোতাবেক নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করতে নীতিমালা তৈরি করা, এবং ভূমি বরাদ্দ ও সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।
বিআইপি এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি এবং সেগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাসযোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সামগ্রিক পরিবেশের কথা ভেবে পরিকল্পনা করলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব। আগামী নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়ানোর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি ।
বিআইপির সাবেক সভাপতি ও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, এলাকাভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীকে বস্তিতে রেখে বাসযোগ্যতার উন্নতি করা সম্ভব নয়।
বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, বিগত এক যুগে অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগের পর ও ঢাকার সূচকে কোন উন্নতি হয়নি। গণপরিবহণ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে, ফুটপাত ও রোড নেটওয়ার্ক বৃদ্ধিতে সংস্থাগুলোকে আরও মনোযোগী হবার জন্যে আহবান জানান তিনি।
বিআইপির সাবেক সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বসবাসযোগ্যতা বাড়াতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হলেও, এই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবে এই পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া, নাগরিকদের মধ্যেও শহরের প্রতি দায়িত্বশীল মানসিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ মোঃ আবু নাইম সোহাগ বলেন, ঢাকা শরে শিশুদের মাঠ কমে যাচ্ছে, খেলার মাঠ ছাড়াই তৈরি হচ্ছে নতুন স্কুলের ভবন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এর জন্য ইতিমধ্যে হাতির ঝিলের এক অংশ ভরাট করা হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অনুসৃত বিকেন্দ্রীকরণ নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন করবার মাধ্যমে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমানোর সাথে সাথে ঢাকার সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকার বাসযোগ্যতার ক্রমশ উন্নতি সাধন করা সম্ভব।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম, বোর্ড সদস্য (একাডেমিক এফেয়ার্স) পরিকল্পনাবিদ উসওয়াতুন মাহেরা খুশি, বোর্ড সদস্য (মেম্বারশীপ এফেয়ার্স) পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদীন প্রমুখ।
ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে বিআইপি'র প্রস্তাবনাসমূহঃ
** অবকাঠামোকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন মডেল এর পরিবর্তন করে বাসযোগ্যতা, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিতাকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো দরকার।
** মেট্রোরেলের পাশাপাশি গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন এর জন্য মানসম্মত বাস সার্ভিস ও প্যারা ট্রানজিট সার্ভিস নিশ্চিত করা এবং হাটবার উপযোগী ফুটপাত নিশ্চিত করা।
** এলাকাভিত্তিক সবার জন্য প্রবেশগম্য খেলার মাঠ - পার্ক- উদ্যান তৈরি করা এবং বিদ্যমান সুবিধাবাদীসমূহ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা।
** আবাসিক এলাকায় পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে পরিকল্পনার মানদন্ড (প্ল্যানিং স্ট্যান্ডার্ড) সংশোধন করা। আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীন শিল্প কারখানা-গুদাম প্রভৃতি সরানোর উদ্যোগ নেয়া।
** নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি, ভূমি বরাদ্দ ও সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা।
** ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দ্রুত প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
** নগর সংস্থাসমুহের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় এর মাধ্যমে সকল ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
** বায়ু-পানি-শব্দ-মাটি দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ এর মাধ্যমে নগর এলাকায় সবুজ এলাকা বাড়ানো।
** খাল-পুকুর-জলাশয়-জলাভূমি রক্ষা এবং ব্লু ও গ্রিন নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে জলাবদ্ধতা কমানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
** এলাকাভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
** সকল ধরনের নাগরিক পরিষেবা এবং সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও অন্তর্ভুক্তিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন; একই সাথে নগর সংস্থাসমুহের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো দরকার।
** উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করবার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
** ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা কৌশল প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।