Blog

27 Jul 2013

Author: Md. Salauddin

পরিকল্পনাকাজে মামলা-জটঃ দুটি প্রস্তাব

দৈনিক সমকালের এপ্রিল ১৮, ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী একমাত্র রাজউকের বিরুদ্ধেই ৫০০০ এর বেশী মামলা ঝুলছে যার বেশীরভাগই জমি সংক্রান্ত।  অনেক মামলাই ১৫ বছর আগের। এত বিপুল পরিমাণ মামলা নিয়ে রাজউক কেন,  যেকোনো সংস্থার কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে বাধ্য। কোর্টে বছরের পর বছর মামলা চললে একদিন হয়ত ন্যায় বিচার আসতেও পারে কিন্তু পরিকল্পনা-উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে।

পরিকল্পনাবিদ  হয়ত দেশ ও মানুষের সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে কোন প্রকল্পে অগ্রসর হলেন কিন্তু একটি মামলাই যথেষ্ট সেই কাজকে থামিয়ে দিতে। জনস্ফীতি আর জমির স্বল্পতা ভবিষ্যতে এই সমস্যাকে  আরও  বাড়িয়ে তুলবে বই কমাবে না। আরও আশংকার বিষয় হল উন্নয়ণ সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। কার্যকর কোনও পদক্ষেপ  নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নাই।

এই দূরারোগ্য রোগ থেকে বাংলাদেশের প্ল্যানিং সিস্টেমকে বের হয়ে আসতে হবে। রোগ নিয়ে বিলাসিতা করার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে- এখন দরকার রোগের ধরণ বুঝে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া। প্রতিকারের জন্য অন্য কোন গ্রহেও যেতে হবে না। প্রতিকার এই পথিবীতেই, এমনকি আমাদের দেশেই আছে। এই মূহুর্তে খুব জরুরী ২ টা পথ্যের কথাই মনে পড়ছে।

১। প্ল্যানিং সিস্টেম??

একটু আগেই একটা গালভরা শব্দ (প্ল্যানিং সিস্টেম) ব্যবহার করেছি আদতে বাংলাদেশে যার অস্তিত্ব নেই। সত্যিকার অর্থে নেই-ই। শহরাঞ্চলে উন্নয়ণ সংস্থা  মাস্টার প্ল্যান করে এবং তারপর ভাবে যে সবকিছু এখন আপন গতিতে চলবে। আমার ২ তলা বাড়ির পাশে ৮ তলা অ্যাপার্টমেন্ট উঠছে অথচ আমার বলার কিছু নাই। পরিকল্পনাবিদ আমাকে জিজ্ঞেসও করবে না। এখন আমি কি করতে পারি? আবার ধরুন ডেভেলপারের একটি প্ল্যান উন্নয়ণ সংস্থা থেকে অনুমোদন করা হয় নি। এখন যদি ডেভেলপার মনে করে তার প্ল্যান ঠিক ছিল তাহলে সে কার কাছে যাবে? সাধারন ভাবে বলতে গেলে অসৎ পন্থাই তখন কি একমাত্র সম্বল হয় না?

এর বিপরীতে ভাবুন এমন এক সংস্থা আছে যার কাছে উন্নয়ণ সংস্থা থেকে প্রত্যাখাত হলে বা কোন উন্নয়ন কাজে অসন্তুষ্ট হলে  আপনার অভিযোগ নিয়ে যেতে পারবেন। বেশীর ভাগ দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। ইংল্যান্ডে এটার নাম Planning Inspectorate’।  বলা যেতে পারে এটা একটা আদালত তবে বিচারিক আদালত থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে এখানকার বিচারক (Planning Inspector) অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদ যারা সরকার দ্বারা নির্বাচিত। এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন আপিলের সমাধান করতে হয়। 

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর গঠন অন্যরকম হতেই পারে তবে এই সংস্থাটি সব উন্নয়ন সংস্থা ও পৌরসভার প্ল্যানিং সেলকে এক ছাতার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। এর আরেকটি উপকারী দিক হল Planning Inspector রা ভৌগলিক সীমানা শেয়ার করা শহর আর শহরতলীর মাষ্টার প্ল্যান কে এক সুতোয় গাঁথতে পারে। দেখা যায় পাশাপাশি ২ টি পৌরসভা প্ল্যান করছে কিন্তু তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। ফলে প্ল্যানগুলো বৃহত্তর আঞ্চলিক উন্নয়ন অর্জনে ব্যর্থ হয়।

২। নাগরিক অংশগ্রহণ

বলা হয়ে থাকে এই অস্ত্রটি ভাল ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে সাধারণের কাছ থেকে বাধা আসার সম্ভাবনা অনেকাংশে দূর করা যায়। অনেকের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে আমাদের শহরের প্ল্যান তৈরির সময় নাগরিক অংশগ্রহণ উপেক্ষা করা হয় অথবা খুবই সামান্য পরিমাণে নিশ্চিত করা হয়, এর অংশগ্রহণের মই (Ladder of Participation) অনুসারে একবারে তলানির Consultatio >বা যা সাধারনভাবে বলতে গেলে প্ল্যান সম্পর্কে জনগণকে শুধুমাত্র জানানো- তাদের কাছ থেকে কোন পরামর্শ নেওয়া এবং প্ল্যানে তা অর্ন্তভুক্ত করা নয়। এর  ফলাফল আমাদের চোখের সামনে। দেশের শহরগুলোর ৯৯ শতাংশ দালানে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ শহরে পর্যাপ্ত পার্ক, খেলাধুলার জায়গা নেই। আমরা কোনদিন আমাদের বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করেছি সে এই শহর পছন্দ করছে কি না- সে কি রকম চায়? মহল্লার বাসিন্দা, ছাত্রী-মহিলাদের জিজ্ঞেস করেছি কোথায় ল্যাম্প পোষ্ট হলে রাতে চলাচল করতে সুবিধা হয় বা যাতায়াতের জন্য কি করা যেতে পারে? কখনও ভেবেছি আমাদের প্রায় এক ফুট উচু ফুটপাত থেকে রাস্তায় হুইল চেয়ার নিয়ে বা বৃদ্ধ একজন উঠবে বা নামবে কিভাবে?

এসব যদি অনেকেই কাছে আদিখ্যেতা- বালখিল্য মনে হয় তাহলে অন্য যুক্তিও আছে। উন্নয়নকাজে নাগরিক অংশগ্রহণ প্রতিদ্বন্দিতা কমায়। প্ল্যান তৈরীর সময় কাওকে অন্তর্ভুক্ত করা মানে সে নিজেকে ঐ কাজের একজন মনে করবে। তারপর যুক্তি-তর্কে তার সুপারিশ যদি নাও গ্রহণ করা হয় তারপরও সে প্রতারিত-অবহেলিত মনে করবে না। ইমিরেটাস প্রফেসর বলেন Reflections of community thinking into planning process would make the people aware and pro-active in the development process and remove barriers । অন্যদিকে বড় বড় ডেভেলপার বা অন্য কোন সংস্থার সাথে একই প্রক্রিয়ায় আলোচনা করা যেতে পারে। তাতে অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি কোর্টে যাওয়া রোধ করা যেতে পারে। এই আলোচনা সময় সাপেক্ষ হলেও তা নিশ্চিত ভাবে ১৫ বছর লাগাবে না। তাছাড়া Planning Inspectorate তো রইল।

এখন দেখা যাক বাংলাদেশ কি অবস্থায় আছে। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাষ্টার প্ল্যানিং করার পদ্ধতি দেখলে বোঝা যায় যে প্ল্যানের বা কাজের লক্ষ্য ঠিক করার পরেই জনগণ ও অন্যান্য সংস্থার সাথে মত বিনিময় করা হয়। লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয় যে এটা করা হয় তথ্য সংগ্রহের সময়। এটা শুধু তথ্য সংগ্রহের একটি উপায়মাত্র, সত্যি কার অর্থে নাগরিক অংশগ্রহণ নয় কারণ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্ল্যানের গুরুত্বপূর্ণ সময়- প্ল্যান তৈরী ও চূড়ান্ত করার সময় কারও উপস্থিতি নেই। প্ল্যান ড্রাফট করার পর অবশ্য আর একবার মত বিনিময় করা হয় কিন্তু সেটা আগের ঐ Consultation পর্যন্তই। সেখানে কিছু আমন্ত্রিত ব্যক্তি বা সংস্থা থাকে। এমনকি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৬ এইও নাগরিক অংশ গ্রহণ নিয়ে কিছু বলা নেই।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি) এ বিষয়ে কাজ করতে পারে। প্রয়োজনে কিছু আইন-বিধি পরিবর্তন, পরিবর্ধণ বা নতুন আইন প্রণয়নে সরকারের সাথে নিবিড় ভাবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশে সব কথার সাথে annex হিসেবে যেটা চলে আসে তা হল দুর্নীতি। প্রথম পথ্যটি কোন কাজে আসবে না যদি দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি থাকে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবেই- সব দেশেই কম বেশী আছে। প্ল্যানিং প্রফেশনে রাজনৈতিক জ্ঞান অতীব জরুরী। প্ল্যানার খুব ভাল প্ল্যান করতে পারে কিন্তু সেটা শেষে রাজনীতি নামক চরম পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আলোর মুখ দেখবে। প্ল্যানারদের প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে পারে সাধারণ জনগণ। শুধু দরকার তাদের কাছাকাছি থাকা।