27 Dec 2022
Author: Mohammad Rasel Kabir
অন্ধের হাতি দর্শন ও নগর পরিকল্পনা
জালাউদ্দিন রূমির একটা লেখার ভাবানুবাদ পড়াতো আমাদের সময়ে, স্কুলে, ইংলিশ ফর টুডে বইতে। কাহিনীটা ছিল এরকম- ছয়জন অন্ধলোক, যারা জীবনে কখনো হাতি দেখেনি, তাদের হাতি দেখার শখ হয়েছিল। তাই বহু কস্টে একদিন হাজির হলো জমিদার মহলে। জমিদার বাড়ির গেইটের সামনেই দাড়ানো ছিলো একটি বিশাল হাতি। প্রথমে এক অন্ধ গিয়ে ধরলো হাতির দাঁত, আর সঙ্গীদের ডেকে বললো, ভাইয়েরা আমি তো হাতি দেখেছি! সঙ্গীরা জিজ্ঞেষ করলো, “বলতো হাতি দেখতে কেমন?” অন্ধ জবাব দিলো, “হাতি দেখতে অনেকটা মুলার মতো”! ২য় অন্ধ ধরেছিলো হাতির কানে, আর সে বললো, “না না হাতির চেহারা মুলার মতো নয় বরং তা হবে কুলার মতো”! ৩য় অন্ধটি ধরেছিলো হাতির পায়ের মধ্যে, তাই সে বলতে শুরু করলো, “হাতি দেখতে হুবাহু গাছের মতন”! ৪র্থ জন হাতির গাঁ ধরে বলল, “হাতি দেওয়ালের মতন”! ৫ম জন শুঁড় ধরে বলল, “না হাতি ঢেঁকির মতন”! শেষেরজন লেজ ধরে বলল যে, “না না, হাতি হল গিয়ে দড়ির মতন”! (অসম্পূর্ণ)
……………………………………………………………………….......................................
বর্তমানে, ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ নিয়ে অনেক আলাপই চলছে। নগর স্থপতি, নগর প্রকৌশলী, নগর পরিবেশবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ, নগর গবেষক, নগর আইনজীবী, নগরবিদ, নগরচিন্তাবিদ, নগর দুশ্চিন্তাবিদ, অতিরিক্ত নগর দুশ্চিন্তাবিদ, সিনিয়র নগর দুশ্চিন্তাবিদ ……… এইরকম অনেক টাইটেল সম্পন্ন বোদ্ধাদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে মিডিয়াতে। ড্যাপের পুরা প্রতিবেদন না পড়ে কেউ পা ধরছে, কেউ কান ধরছে, কেউ শুঁড় ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। সুর তালও ঠিক মেলাতে পারছে না কেউ কেউ চর্চার অভাবে। “যারে দেখতে নরি, তার চলন বাঁকা”-এভাবেই ড্যাপের দোষ ধরতে ব্যস্ত সবাই। পুরা প্রতিবেদনটাও কেউ পড়ে দেখছে না। দেখতে চাইছে না আসলে নগর পরিকল্পনার দর্শণটুকু। নগর পরিকল্পনায় শুধু ভৌত পরিকল্পনাই করা হয় না, এখানে প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবা হয়। নাগরিকদের জন্য পরিকল্পনা করা হয়, জীব বিচিত্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে ভাবা হয়। ভাবা হয় এখানে বসবাসরত মানুষের শারিরিক ও মানষিক স্বাস্থ্য নিয়ে, কর্মসংস্থান নিয়ে, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিনোদন নিয়ে। চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী না থেকে কিভাবে নিজের আবেগ, অধিকার, ও স্বাধীনতা নিয়ে মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে জীবন যাপন করতে পারবে তারই প্রতিফলন ঘটে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে। শুধু “মশার ঝিলকে” আলোকিত “হাতির ঝিল” বানানোর মধ্যেই নগর পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ না, এটা বুঝতে হবে। খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট বানানো, ব্যক্তিগত কারের জন্য দ্বিতল রাস্তা তৈরি, বা টিনটেড গ্লাসে মোড়া সুউচ্চ বিল্ডিং বানিয়ে শহরের তাপমাত্রা ও জনঘনত্ব বাড়ানোর অপপ্রক্রিয়ার সাথেও নগর পরিকল্পনার আদর্শিক জায়গাটা সবসময়ই সাংঘর্ষিক। সংশ্লিষ্ট কিছু পেশাজীবীরা এসব আমলে না নিয়ে এক্টিভিস্ট বা রাজনীতিবিদদের মতোন আচরণ শুরু করেছে, যা মোটেও কাম্য নয়। তাদের জন্য গল্পের বাকি অংশটকু রইলো…
……………………………………………………………………….......................................
পাশে দাড়িয়ে মাহুত (হাতির রাখাল) তাদের কথাগুলো শুনছিলো! একপর্যায়ে মাহুত বললোঃ ভাই তোমরা যেভাবে হাতিটি দেখেছো, সে দেখা সঠিক নয়। হ্যা, হাতির দাত গুলো মুলার মতোই বটে, তার কান যুগল কুলার মতো, আর পা যুগল গাছের মতোই। তাই বলে হাতির চেহারা মুলা, কুলা আর ঢেকির মতো নয়! তার নাম যেমন হাতি, চেহারাটাও হাতিরই মতো!! এতক্ষনে সব অন্ধ মাহুতের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো! মাহুত যতই বুঝাতে চেস্টা করে, অন্ধগুলো ততই ক্ষেপে উঠে, আর মাহুতকে উদ্দেশ্য করে বলে, “বেটা আগে হাতির গায়ে হাত দিয়ে ভালো করে জানো, তার পর হাতি নিয়ে মন্তব্য করো”!!
……………………………………………………………………….......................................
পরিশিষ্টঃ “অন্ধ” হলেও কোন সমস্যা নাই, যেহেতু নগর পরিকল্পনা “সার্বজনীন প্রবেশগম্যতা”র আদর্শ ধারণ করে। কিন্তু চোখ থাকিতে অন্ধ হলে বা বৃহত্তর স্বার্থ বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থকে প্রধান্য দিলেই বিপত্তি। হাতির দাঁত, কান ধরে “মূলা/কুলা” বোঝার মতন এক্সপ্রেসনিস্ট বোদ্ধাদেরও দরকার আছে নগর পরিকল্পনা প্রণয়নে ও উন্নয়নে, কিন্তু হাতির মাহুত সেজে বসলে তো বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ, “হাতাহাতি” করে খুব বেশি যে “লাভ” হয় না সেটা সর্বজনগ্রাহ্য, হাতি চেনা তো বহুদূর!