Blog

20 Jul 2013

Author: Bayes Ahmed

ঢাকার নগরায়নের ধারা এবং যথোচিত নগর পরিকল্পনার ভূমিকা

পটভূমি

ঢাকা প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এক সময় ঢাকা জগত-বিখ্যাত ছিল এর মসলিন কাপড়, মসজিদ এবং বাণিজ্যের জন্য। কিন্তু সময়ের প্রবাহে এই রূপরেখার পরিবর্তন ঘটেছে।

পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরের মত, ঢাকা শহরও গড়ে উঠেছে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং অপরিকল্পিত উপায়ে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা খুবই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই শহরকে পরিণত করেছে পৃথিবীর একটি অন্যতম জনবহুল এবং বৃহৎ মহানগরে (Mega-City)।

১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩.৩৬ লক্ষ, যা ২০১২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১.৫ কোটিতে। ভাল চাকরির সুযোগ, উন্নত শিক্ষা/চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য আধুনিক সুবিধার কারণে সমগ্র দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ঢাকার দিকে ছুটে আসছে হাজারো মানুষ। এর ফলে ঢাকা শহর পরিণত হচ্ছে একটি আধুনিক যুগের বস্তিতে। ঢাকা এখন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মাত্রাতিরিক্ত নগর দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক পানি (নর্দমার) নিষ্কাশনে অচলাবস্থা, অবৈধ বসতি ও বস্তি স্থাপন, যানজট, পরিবেশ দূষণ এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যায় ব্যাপকভাবে জর্জরিত।

তাছাড়াও এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার চাপে ঢাকা শহরের অনুভূমিক (Horizontal) এবং ঊর্ধ্বমুখী (Vertical) উভয় ধরণের প্রসারণ ঘটছে। এর ফলে ঢাকা ও এর আশে-পাশের যাবতীয় জলাধার (Water Retention Area), মুক্তস্থান (Open Space), খেলার মাঠ, জলাভূমি (Water Body), কৃষিজমি, বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল, বন-জঙ্গল, গাছপালা, গ্রামীণ বসতি এবং রাস্তাঘাট দখল হয়ে সেখানে নির্মিত হচ্ছে কনক্রিটের ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো।

এইসব নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ঢাকা এখন পরিণত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বসবাসযোগ্য শহরে।

সমস্যা চিহ্নিতকরণ

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ১৯৮৯ সালে বৃহত্তর ঢাকা শহরের নগরায়ণের (রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, অবকাঠামো ইত্যাদি) পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩.৪%। যা ২০০৯ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬%-এ। অন্যদিকে এই দুই দশকে (১৯৮৯-২০০৯) পতিত জমি, নিম্নভূমি, কৃষি জমি, গাছপালা এবং জলাভূমির পরিমাণ কমেছে লক্ষণীয়ভাবে (মানচিত্র-১)।

এইধরনের মানচিত্র আধুনিক ‘GIS’ এবং ‘Remote Sensing’ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রস্তুত করা সম্ভব। সামগ্রিক ধারণা অর্জনের জন্য এসকল সময়গত মানচিত্র খুবই কার্যকর।

বিগত দুই দশকের এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০১৯ সালে ঢাকায় নগরায়ণের (Builtup Area) পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯%-এ। এইরকম দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ যে কোন শহরের জন্য হুমকিস্বরূপ।


 

মানচিত্র-১: ঢাকার নগরায়ণের ক্রমবিকাশ (১৯৮৯-২০০৯)

 

ঋণাত্মক প্রভাব

দ্রুত গতির নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহর বিভিন্ন রকম মনুষ্য-সৃষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘Urban Heat Island (UHI)’-এর প্রভাব। UHI-এর ফলে শহর অঞ্চলের তাপমাত্রা অধিক থাকে এর আশপাশের গ্রাম-এলাকা থেকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অধিক নগরায়ণের ফলে UHI-এর প্রভাব বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ঘন-বসতিপূর্ণ নগর এলাকার গড় তাপমাত্রা এর আশেপাশের কম ঘন-বসতিপূর্ণ এলাকার চেয়ে অধিক থাকে। UHI প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ বলে আধুনিক যুগে বিবেচিত হয়।

ঘরবাড়ি, কনক্রিট, রাস্তার অ্যাসফাল্ট এবং শিল্পসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড UHI-প্রভাব সৃষ্টির প্রধান কারণসমূহ। প্রাকৃতিক ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের আবরণকে নষ্ট করে গড়ে ওঠা দালানকোঠা, ফুটপাথ এবং অন্যান্য অবকাঠামো; প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমণ্ডলকে ঠাণ্ডা করা থেকে বিরত রাখে। এছাড়াও সুউচ্চ ভবন এবং অপ্রশস্ত রাস্তা, গরম বাতাস আটকে রাখে এবং স্বাভাবিক বায়ু-প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। সর্বোপরি যানবহন, কলকারখানা এবং শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে নির্গত তাপ এই UHI-প্রভাবকে আরও ত্বরান্বিত করে।

UHI স্থানীয় আবহাওয়া এবং জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও UHI-এর প্রভাব যে শহরে বেশি থাকে, সেই শহরের বায়ু দূষণের মাত্রাও বেশি থাকে। এর ফলে এই ধরণের UHI আক্রান্ত নগরবাসী নানাবিধ বায়ু দূষণ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত রোগে জর্জরিত থাকেন। সুতরাং ঢাকার UHI নিয়ে গবেষণা করা খুবই জরুরী এবং সময়-উপযোগী, যা ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে সহায়তা করতে পারে।

বিশ্লেষণ এবং ফলাফল

ঢাকার UHI এর প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য, ‘GIS’ এবং ‘Remote Sensing’ প্রযুক্তির মাধ্যমে, বিগত দুই দশকের (১৯৮৯-২০০৯) তাপমাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অঞ্চলের ক্রমবিকাশের মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছে (মানচিত্র-২)।





মানচিত্র-২: ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অঞ্চলের ক্রমবিকাশ (১৯৮৯-২০০৯)

 

গবেষণার জন্য সমগ্র ঢাকা শহরকে ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস (°C) তাপমাত্রার মধ্যে ছয়টি তাপ অঞ্চলে (Heat Zone) ভাগ করা হয়েছে। নিম্ন তাপমাত্রা ‘সবুজ’ রঙ, মধ্যম তাপমাত্রা ‘কমলা’ রঙ এবং উচ্চ তাপমাত্রা অঞ্চল নির্দেশক হল ‘লাল’ রঙ। এভাবে মানচিত্র প্রস্তুত করার পর আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পারছি যে, ১৯৮৯ সালে ঢাকার বেশিরভাগ অঞ্চল ছিল ‘নিম্ন তাপমাত্রা’ অঞ্চলভুক্ত। ১৯৯৯ সালে যা মধ্যম তাপমাত্রা অঞ্চলে এবং ২০০৯ সালে উচ্চ তাপমাত্রা অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (মানচিত্র-২)।

অর্থাৎ বিগত দুই দশকে (১৯৮৯-২০০৯) ঢাকায় ‘Urban Heat Island (UHI)’-এর প্রভাব প্রকট হয়েছে এবং এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মানচিত্র ১ এবং ২ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ঢাকায় ‘নগরায়ন’ (Builtup Area) বৃদ্ধির সাথে সাথে ‘উচ্চ-তাপ অঞ্চলের’ (Urban Heat Island) পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরামর্শ

এমতাবস্থায় ঢাকার UHI-এর প্রভাব কমাবার এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ খুবই জরুরী ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উচিতঃ

১. ঢাকার জন্য একটি সময়-উপযোগী/ আধুনিক মহাপরিকল্পনা (Master Plan) প্রস্তুত এবং প্রণয়ন করা।

২. ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের (Decentralization) আওতায় আনা।

৩. ঢাকায় বৃক্ষ রোপণ, বনায়ন এবং সবুজায়নকে গুরুত্ব দেয়া।

৪. ঢাকার প্রাকৃতিক খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, হ্রদ এবং জলাধারগুলোকে রক্ষা করা।

৫. ‘Vegetation Index’ এবং ‘Green Roof’-এর মতো আধুনিক ধারণাকে নগর পরিকল্পনার সাথে অন্তর্ভুক্ত করা।

উপসংহার

ঢাকাকে একটি আধুনিক এবং বসবাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করার জন্য ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন’ এককভাবে চরম হুমকিস্বরূপ। এর সাথে ‘Urban Heat Island (UHI)’; প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে, ঢাকাকে নিকট ভবিষ্যতে একটি ‘পরিত্যক্ত নগরী’ হিসাবে ঘোষণা করতে হতে পারে।

এমতাবস্থায় UHI-এর প্রভাব কমানোর জন্য, ঢাকার নগরায়নের ধারাকে করতে হবে সুসংহত। একমাত্র পরিকল্পিত নগরায়নই হতে পারে এর সুষ্ঠু সমাধান। তাই সময় এসেছে, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সাথে নিয়ে ঢাকার বর্তমান মহাপরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়ন করা এবং নিকট ভবিষ্যতের জন্য একটি আধুনিক মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা।