Blog

24 Oct 2013

Author: Bayes Ahmed

সড়ক দুর্ঘটনা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তাঃ মূল বিষয়সমূহ এবং করণীয়!

পটভূমি

সারাবিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব মতে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১৩ কোটি মানুষ নিহত এবং ২০-৫০ কোটি মানুষ আহত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭০% মানুষই নিহত হয় বাংলাদেশের মত নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। এছাড়াও বর্তমান বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা হল, ৫-৪৪ বছর বয়স সীমার মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় মুখ্য-কারণ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর গড়ে ৪০০০ মানুষ নিহত এবং ৫০০০ মানুষ আহত হয়। এর ফলে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ২% পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি বছর দশ হাজার নিবন্ধিত মোটরযান প্রতি প্রায় ৮৬ মৃত্যু সংগঠিত হয়। এই হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২, যুক্তরাজ্যে ১.৪ এবং অন্যান্য উন্নত দেশে মাত্র ৫। অর্থাৎ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উন্নত দেশগুলোর চেয়ে প্রায় ১৮ গুণ বেশি।

গবেষণা এলাকার পরিলেখ

পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরের মত, ঢাকা শহরও গড়ে উঠেছে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং অপরিকল্পিত উপায়ে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের রাজধানী হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা খুবই দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই শহরকে পরিণত করেছে পৃথিবীর একটি অন্যতম জনবহুল এবং বৃহৎ মহানগরে (Megacity)।

১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩.৩৬ লক্ষ, যা ২০১২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১.৬ কোটিতে। ঢাকা এখন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মাত্রাতিরিক্ত নগর দারিদ্র্য, অবৈধ বসতি স্থাপন, যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা, পরিবেশ দূষণ এবং অন্যান্য নানাবিধ আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পরিণত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বসবাসযোগ্য শহরে।

সারণী-১ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রধান চারটি শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। এই কারণে বৃহত্তর ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকাকে (DMA) সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক এই গবেষণার এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে (মানচিত্র- ১)।

সারণী-১: বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র (২০০৯)

শহরের নাম সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা সড়ক দুর্ঘটনার হার
তীব্রতা সর্বমোট
দুর্ঘটনা
প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যা
প্রাণনাশ মর্মান্তিক
আহত
লঘুতর
আহত
প্রাণনাশ
দুর্ঘটনা
আঘাত জনিত দুর্ঘটনা
ঢাকা ৩১৫ ১১৩ ২৩ ৪৫১ ০.৪৯২ ০.৭০৪
রাজশাহী ২০ ২৮ ০.৪৩৮ ০.৬১৩
খুলনা ২৮ ৩৮ ০.৩০৪ ০.৪১৩
চট্টগ্রাম ৬০ ১৭ ৭৮ ০.১৫৭ ০.২০৫

সূত্রঃ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (২০১০)

মানচিত্র- ১: গবেষণা এলাকা (ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা)


তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ

গবেষণার প্রয়োজনে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান কার্যালয় থেকে ২০০৭-২০১১ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২,৭২০ টি সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন ফর্ম সংগ্রহ করা হয়। এরপর সংগৃহীত উপাত্ত-সমূহকে ‘GIS’ প্রযুক্তির সাহায্যে মানচিত্রে উপস্থাপন এবং বিভিন্ন ধরণের পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণা এলাকার বিভিন্ন সড়কে সংগঠিত দুর্ঘটনার অবস্থান মানচিত্র- ২ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান।

মানচিত্র- ২: বৃহত্তর ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার দৃশ্যবিবরণী (২০০৭-২০১১)


ফলাফল

সংগৃহীত উপাত্ত এবং তথ্য থেকে গবেষণালব্ধ ফলাফলসমূহ নিম্নরূপঃ

  • ফুটপাথের বাছ-বিচারহীন ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা, অদক্ষ চালক, ফুট ওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা এবং পর্যাপ্ত আইনগত শাস্তির অভাব ইত্যাদি হল ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণসমূহ।
  • দুর্ঘটনার প্রতিবেদনের জন্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং ফর্ম পূরণের পদ্ধতিতে বিস্তর দুর্বলতা আছে, যা সঠিক তথ্য উপস্থাপনের পথে প্রধান বাঁধা।
  • ঢাকার সবচেয়ে বিপদজনক ৫ টি সড়ক হলঃ ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক, বিমান বন্দর রোড, মিরপুর রোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং বেড়িবাঁধ সড়ক।
  • ঢাকায় বিগত ৫ বছরের (২০০৭-২০১১) সড়ক দুর্ঘটনায় ২,০৫৭ জন নিহত এবং ৮৭০ জন আহত হয়েছেন। এই সকল দুর্ঘটনায় ৩,৭৫১ টি যানবহন নিয়োজিত ছিল।
  • বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা প্রাণনাশের কারণ (৬৯%) এবং পথচারীকে আঘাত করেছে (৬০%)।
  • এই সড়ক দুর্ঘটনাগুলো সংগঠিত হয়েছে সমতল রাস্তায় (৯৭%), যেখানে যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নেই (৬৩%), কোন সংযোগস্থল নেই (৭১%), দিবালোকে (৫৪%), যেখানে সড়ক বিভাজক আছে (৮০%) এবং একমুখী রাস্তাতে (৭৩%)।

সুপারিশমালা

শহুরে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি; দুর্বল ও নিম্নমানের রক্ষণা-বেক্ষণ বিশিষ্ট অবকাঠামো; দুর্বল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান/প্রশাসন; পরিকল্পনা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকা; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং পৌর-সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সর্বোপরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যানবাহনের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি হল ঢাকার সড়ক পরিবহন সংক্রান্ত সমস্যার মূল কারণসমূহ। এমতবস্থায় নিম্নলিখিত ৪ টি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবেঃ

  • প্রকৌশল দৃষ্টিকোণঃ রাস্তার জ্যামিতিক বহির্বিন্যাসের উন্নতি করা, পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত/নিরাপদ পারাপার ও ফুটপাথের ব্যবস্থা করা, মোটরগাড়ি এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের পৃথক ব্যবস্থা, প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা-পৃষ্ঠ ঠিক করা, ট্রাফিক চিহ্ন, ট্রাফিক সংকেত, গতি নিয়ন্ত্রণ এবং সড়কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
  • আইন বলবত্করণ দৃষ্টিকোণঃ ট্রাফিক আইন ও বিধি লঙ্ঘনের জন্য পর্যাপ্ত শাস্তির বিধান রাখা ও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা, নিরাপত্তার জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে সরকার অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ দ্বারা সড়ক নিরীক্ষা করা, রাস্তা/ফুটপাথের বে-আইনি ব্যবহার এবং যথেচ্ছা গাড়ি পার্কিং নির্মূল করা ইত্যাদি।
  • শিক্ষাগত দৃশ্য রূপসমূহ: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ফর্ম সঠিকভাবে পূরণ করার বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান; অধিক হারে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণপ্রচার কার্যক্রম গ্রহণ করা; সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা, স্টেকহোল্ডার, এনজিও, প্রাইভেট কোম্পানি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ; ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট-মিডিয়া সমূহের নিয়মিতভাবে সড়ক নিরাপত্তার নিয়ম এবং দুর্ঘটনা ঘটার সংবাদ প্রকাশ করা ইত্যাদি।
  • জরুরি প্রয়োজনে দৃষ্টিভঙ্গি: দুর্ঘটনার পর দৈহিক অসুস্থতা/ মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জরুরি সহায়তা প্রদানের দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে, সকল সাধারণ হাসপাতালে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ট্রমা-বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করতে হবে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করা উচিত।

উপসংহার

বিশ্বব্যাপী পূর্বাভাস ইঙ্গিত করে যে, পরবর্তী ১০ বছরে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর মাধ্যমে হতাহতের সংখ্যা ভীতিপ্রদ আকারে বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায় পেশাদার সড়ক-নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অনুপস্থিতি এবং সম্পদের অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরও গুরুতর করে তুলেছে।

জাতীয় এই হুমকিকে হ্রাস করতে প্রয়োজনীয় কঠোর এবং সমালোচনামূলক ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য গুরুত্ব দিতে হবে- পর্যাপ্ত সমস্যা ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয় করা, টেকসই তহবিল গঠন, কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, ভাল প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ এবং নিবেদিত-প্রাণ জনবল নিয়োজিত করা ইত্যাদি; যারা এই সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রশমন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ব্যবহার-পূর্বক একটি সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক নীতিমালা, নগর ও অঞ্চল সংশ্লিষ্ট সকল মহাপরিকল্পনার সাথে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

    বিঃদ্রঃ লেখাটি পূর্বে বিআইপি'র [সংখ্যা- ১৪ (ডিসেম্বর ২০১২)] নিউজলেটারে প্রকাশিত হয়েছিল!